Breaking News
আম্পানে উদ্বাস্ত হয়ে বাঁধের ওপর বসতি। সম্প্রতি খুলনার কয়রায় উত্তর বেদকাশিতে ছবি: সাদ্দাম হোসেন

আম্পানের ৮ মাস পরও বাঁধে কাটছে জীবন

অনলাইন ডেস্ক :

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর মরদেহ দাফনের জন্য সাড়ে তিন হাত শুকনো জায়গা না পাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের স্বজন হারানো মানুষদের। তাঁদেরই একজন মাঝবয়সী রানুফা বেগম বাস করতেন কপোতাক্ষের পাড়ে। ঝড়ের দিন মাত্রই খেতে বসেছিলেন। হঠাৎ বাতাসের বেগ বাড়ল, শুরু হলো জোয়ার। পানির তোড়ে চোখের সামনেই ভাতের হাঁড়ি ভাসতে ভাসতে চলে গেল নদীতে।

রানুফা নৌকায় উঠে কোনোমতে প্রাণে বাঁচেন। আশ্রয় নেন স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে। আট মাস ধরে সেখানেই রয়েছেন। কবে, কোথায় ফিরতে পারবেন, তা অজানা। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর সাতক্ষীরার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি গ্রামের কোনো কোনো পরিবারকে তিন বছরও আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয়েছিল।

এ অভিজ্ঞতা সুন্দরবনঘেঁষা উপকূলীয় অঞ্চলের হাজারো মানুষের। ২০২০ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বাস্তুহীন হওয়া কয়েক হাজার মানুষের আর ফেরার জায়গা নেই। ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, ঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি কম হলেই ক্ষতি কম হয় না। যে নদী খালের মতো ছিল, বাঁধ ভেঙে তা প্রশস্ত হয়েছে। বেড়েছে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা, ভেঙেছে অবকাঠামো। দিনে চারবার জোয়ার-ভাটার এ অঞ্চলে ক্রমাগত লোনা পানির কারণে উর্বরতা হারিয়েছে ফসলি জমি, মরছে গাছ-মাছ। পরিত্যক্ত অনেকটা জনমানুষহীন কয়েকটি গ্রাম।

রানুফা নিজের বিলীন হওয়া ভিটার যে জায়গাটি আঙুল দিয়ে দেখালেন, সেখানে এখন কপোতাক্ষ বিস্তীর্ণ। আরেক পাশ দিয়ে এসে মিশেছে খোলপটুয়া নদী। বিলীন হয়েছে প্রতাপনগরের অনেকখানি। এই কপোতাক্ষপারেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের আদি বসতি।

আম্পানে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি। শুষ্ক মৌসুমের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ শেষ না হলে পুরো নিশ্চিহ্ন হতে পারে আরও কয়েকটি গ্রাম।

বাস্তুহীন মানুষের জীবিকা

আম্পান থেকে এখন পর্যন্ত পুরোটাই মহামারিকাল। এ সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলের বহু মানুষের পেশার বদল হয়েছে। এক ফসলি জমিতেও যাঁরা সাহস নিয়ে ধানের চাষ করেছিলেন, তাঁরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের একবেলার বৃষ্টিতে।

নারী-পুরুষ অনেকেই এখন শামুক খুঁটে বিক্রি করেন। এক কেজি শামুক সংগ্রহ করতে লাগে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট, যা প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৩ থেকে ৪ টাকায়। শামুক তুলতে তুলতে হাতের তালু ক্ষয়ে যায়। লোনা পানিতে চর্মরোগের ইতিহাস এ অঞ্চলে বহু পুরোনো।

কয়রার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাশিরহাটখোলা গ্রামে বেড়িবাঁধে থাকা শিখা রানী বললেন, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মিঠা পানির কোনো মাছ পাওয়া যায় না। স্বামী দিনমজুর হয়েছে কিন্তু করোনার জন্য কাজও নেই। আম্পানে উদ্বাস্তু হয়ে বাঁধের ওপর একটি ঝুপড়ি ঘরে প্রতিবন্ধী ছেলেসহ থাকেন তাঁরা। এখানকার মানুষেরা ছিলেন নদী বা বননির্ভর জীবিকার। উদ্বাস্তু হয়ে এখন অনেকটা দূরে এসে ঠাঁই নেওয়ায় পরিণত হয়েছেন দিনমজুরে।

আট মাস ধরে প্রতাপনগরের ইউনাইটেড একাডেমির আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে বাস করছে ২৬টি পরিবারের শতাধিক মানুষ। ভেঙে যাওয়া সড়কের দুই পাশে আশ্রয় হয়েছে বাকিদের। প্রতাপনগরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মুক্তা আক্তার এখন আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলায় থাকেন। জানালেন, জোয়ার এলে আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলায় পানি আসে। রাতে ছেলেমেয়ে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হয়।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের হিসাবে, উত্তর বেদকাশির তিন হাজারের বেশি মানুষ ঝড় ও পরবর্তী জলোচ্ছ্বাসে উদ্বাস্তু হয়েছে। তাদের মধ্যে স্থানীয় বাঁধে বসবাস করছে এক হাজারের বেশি উদ্বাস্তু।

আট মাস ধরে প্রতাপনগরের ইউনাইটেড একাডেমির আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে বাস করছে ২৬টি পরিবারের শতাধিক মানুষ। ভেঙে যাওয়া সড়কের দুই পাশে আশ্রয় হয়েছে বাকিদের। প্রতাপনগরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মুক্তা আক্তার এখন আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলায় থাকেন। জানালেন, জোয়ার এলে আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলায় পানি আসে। রাতে ছেলেমেয়ে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হয়। শৌচাগার বা টয়লেট উপচে ময়লা-আবর্জনা ভাসতে থাকে ঘরের পানিতে। সকাল হলে সেই মেঝেতেই চলে খাওয়া, বসা, হাঁটাচলা।

যাঁরা নিজ বাড়িতে আছেন

কয়রা ও সাতক্ষীরার যেসব স্থানের মানুষ ঝড়ের পরও নিজের বাড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদেরও আছে নানা সমস্যা। বাঁধের ভাঙা অংশই যেমন উদ্বাস্তু মানুষের থাকার জায়গা, তেমনি এসব পথই গ্রামের অন্য বাসিন্দাদের যাতায়াতের পথ।

প্রতাপনগর ও উত্তর বেদকাশিতে কয়েকটি জায়গায় দেখা গেল ঝুঁকিপূর্ণভাবে নদীর ধার ঘেঁষে থাকছে অনেকেই। ঘরের একটি অংশ যেকোনো সময় তলিয়ে যেতে পারে। প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও এসব জায়গা থেকে তারা সরে যায়নি। আছে সুপেয় পানির অভাব। জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, না হলে কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয় এক কলসি বিশুদ্ধ পানির জন্য।

আছে জলাবদ্ধতার সমস্যা। প্রতিটি বাড়ির সামনে পানি জমে থকথকে কাদায় চারপাশ থেকে আসছে দুর্গন্ধ। জোয়ারে পানি উঠে এলেও ভাটায় সমান টানে পানি নামছে না এসব স্থানে।

ভাঙনের কয়েক মাস পর

সাতক্ষীরার আশাশুনির প্রতাপনগরের ৮টি জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে আম্পানে। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে ৩০ কিলোমিটার। প্রতাপনগর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন বলেন, ওই ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৮ হাজারের বেশি পরিবার। কয়েক মাস ধরে উপকূলীয় এ এলাকায় ৩৬ হাজার মানুষ পানিবন্দী। গত আগস্টের শেষে আবার জোয়ারের পানিতে ডুবেছে প্রতাপনগর। মূল সড়কের একাংশ তলিয়ে থাকায় এ ইউনিয়নের সঙ্গে এখনো সদরের স্থলপথের সংযোগ নেই। বিপর্যস্ত পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা।

এদিকে কয়রা উপজেলার চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, ১২১ কিলোমিটারের মধ্যে ৭০ কিলোমিটার বাঁধের অবস্থা নাজুক। আম্পানে তাঁর উপজেলায় দক্ষিণ বেদকাশির ছোট আংটিহারা, গোলখালিসহ ৯টি জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে। মোট ১৪টি পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১৩টি জায়গা রিং বাঁধ দিয়ে আপাতত পানি আটকানো হয়েছে।

স্থায়ী সমাধানের দাবি

ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনার কয়রা ও দাকোপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ২০০ কিলোমিটার আর সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৪০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এর মধ্যে অনেকাংশে আর সংস্কার হয়নি। অরক্ষিত জায়গা ভাঙছে সহজেই। একই সঙ্গে তাদের অভিযোগ, বাঁধে অতিরিক্ত স্লুইসগেট তৈরি এবং পাইপ বসিয়ে সাইফেন পদ্ধতিতে নদীর লোনা পানি টেনে চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধে।

প্রতাপনগরের মানুষেরা গত ১৯ অক্টোবর টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবিতে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে এক বেলা পানিতে দাঁড়িয়েছিল। শুধু আম্পান নয়, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই প্লাবিত হয় এসব অঞ্চল। এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে রাজা প্রতিপাদিত্যের নামে নামকরণ করা প্রাচীন এ জনপদের কয়েকটি গ্রাম। এক মাসের মধ্যে বাঁধ না হলে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে প্রতাপনগর নামটি মুছে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন।

১২১ কিলোমিটারের মধ্যে ৭০ কিলোমিটার বাঁধের অবস্থা নাজুক। আম্পানে তাঁর উপজেলায় দক্ষিণ বেদকাশির ছোট আংটিহারা, গোলখালিসহ ৯টি জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে। মোট ১৪টি পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১৩টি জায়গা রিং বাঁধ দিয়ে আপাতত পানি আটকানো হয়েছে।

শফিকুল ইসলাম, কয়রা উপজেলার চেয়ারম্যান

বাঁধ অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ কয়রার মানুষদেরও। সংস্কারহীন, পলি ব্যবস্থাপনা না করেই বাঁধ নির্মাণ এবং তদারকি না থাকায় ঝড় এলেই ভাঙছে। তাঁরা বলছেন, বাঁধ মেরামতের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের হলেও দুর্নীতির জন্য সীমাহীন এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ যা বলছে

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল খুলনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিক উল্লাহ বলেন, ষাটের দশকে এ বাঁধগুলো তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল সমুদ্রের লোনা পানি ও বন্যা থেকে স্থানীয় এলাকার মানুষ ও ফসল রক্ষা করা। পরবর্তী সময়ে পানি ও পলির ‘অ্যাকটিভিটিজ’ পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি বলেন, চিংড়ি চাষ অধিক লাভজনক। তবে চিংড়ি চাষের কারণে বাঁধের ভেতর পানি জমে থাকছে। এতে বাঁধ দুর্বল হচ্ছে। জোয়ার-ভাটায় পানি মাটির বাঁধগুলোকে বারবার আঘাত করে, ফলে তা আরও দ্রুত ভাঙনের মুখে পড়ে।

রফিক উল্লাহ আরও বলেন, অনেক বাঁধ ছিল নদীর খুব কাছাকাছি, যেগুলো পিছিয়ে আনতে হচ্ছে। জায়গা পরিবর্তন করে আরও ভেতরের দিকে বাঁধ বানাতে গেলে তখন আবার স্থানীয় মানুষের জমি অধিগ্রহণের প্রসঙ্গ আসে। এতে স্থানীয়দের ক্ষতি বেশি হয় এবং এটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তিনি উল্লেখ করেন, বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চিংড়ি চাষকে নির্দিষ্ট দূরত্বে অর্থাৎ বাঁধ থেকে ৫০ থেকে ১০০ মিটার দূরে রাখা হয়, সে বিষয়গুলো নজরদারিতে আনা হচ্ছে।

স্থানীয়দের সমাধান

স্থানীয় লোকজন জানান, বর্ষার সময় এমনিতেই জোয়ারের পানির চাপ বাড়ে। তখন বাঁধ সংস্কার বা নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। জোয়ারের পলি ও পানি ব্যবস্থাপনা করে বাঁধ নির্মাণ এবং নিয়মিত সংস্কারই একমাত্র সমাধান বলে মনে করছেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। তবে তা শুষ্ক মৌসুমের মধ্যেই শেষ হতে হবে। একই সঙ্গে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর দাবিও রয়েছে তাঁদের। তাঁরা বলছেন, আম্পানে বেশি ক্ষতির কারণ বাঁধের চেয়ে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বেশি ছিল।

প্রাচীন পদ্ধতিতে অষ্টমাসী বা ষষ্ঠমাসী বাঁধ নির্মাণ সম্ভব কি না জানতে চাইলে তাঁরা উত্তর দিলেন, লবণাক্ততার পাশাপাশি নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা ও গতি দুই-ই বেড়েছে। সে ব্যবস্থা এখন আর বড় জলোচ্ছ্বাসের দাপট আটকাতে পারবে না। কয়েক দফায় গ্রামের মানুষ স্থানীয়ভাবে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা ভেঙেছে সঙ্গে সঙ্গে। ফলে প্রাচীন পদ্ধতি কতটা কার্যকর হতে পারে, তা নিয়ে আছে সন্দেহ। স্বল্প সময়ের এ ধরনের বাঁধ অতিরিক্ত উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস এবং জোয়ারে দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে মন্তব্য তাঁদের।

আশাশুনির প্রতাপনগরের মাহবুব গাজী বলেন, আসলে বড় ও টেকসই বাঁধ দরকার। ছোট ছোট বাঁধ নির্মাণ করে কোনো লাভ হবে না।

ফলে সেই প্রশ্নই আবার সামনে আসে। আসছে বর্ষাকাল। আবার যদি বড় কোনো ঝড় আসে আর তার আগেই উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না হয়, তাহলে কী হবে!

সুত্র : প্রথম আলো

Print This Post

About Amena Fatema

Check Also

রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ

বাংলাদেশ-রাশিয়া সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর …

Leave a Reply