অনলাইন ডেস্ক :
স্বভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা, আচরণে ক্ষতিকর- এমন এক প্রজাতির পিঁপড়ার জন্মস্থান খুঁজতে বেরিয়েছিলেন হার্ভার্ড গবেষক ওয়ারিং ট্রাইবল। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে এসে মিলিছে তাদের সন্ধান। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অফিসিয়াল নিউজ সাইট হার্ভার্ড গেজেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত-পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে এসে ওই পিঁপড়ার খোঁজ পান ওয়ারিং। অনুসন্ধানের বিস্তারিত গত জুনে বায়োলজি লেটারসে প্রকাশ করেন। তাতে ওয়ারিং জানান, অধিকাংশ পিঁপড়াই দ্রুত বংশ বিস্তারে সক্ষম। এদের বেশ কিছু ক্ষতিক্ষর প্রজাতি মানুষের নানা ধরনের কর্মকা-ে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়েছে। তাদের সহজাত আচরণ সম্পর্কে বিশদ জানতে পারলে বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন এই গবেষক।
ওয়ারিং তার আর্টিকেলে বলেছেন, ক্লোনাল রাইডার অ্যান্ট নামের এই প্রজাতি বাংলাদেশ থেকেই পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। আমরা প্রজাতিটির নিকটতম বিবর্তনীয় আত্মীয় খুঁজতে চেয়েছিলাম, যাতে ল্যাবে তাদের নিয়ে গবেষণা করা যায়। ছড়িয়ে পড়াদের বাদ দিয়ে নিজেদের জন্মস্থানে পিঁপড়াগুলোকে শনাক্ত করা গেলে সহজাত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও ভালো জানা যায়। কী কারণে তারা এত আক্রমণাত্মক, সেটিও ভালো বোঝা যায়।
সহকর্মী শন ম্যাকেনজিকে নিয়ে ওয়ারিং এই পিঁপড়ার সন্ধানে বের হন। প্রফেসর ড্যানিয়েল জেসি ক্রোনাউরের ল্যাবে কাজ করার সময় তারা ভারতে প্রায় একই ধরনের একটি পিঁপড়া শনাক্ত
করেন। এটিকে তারা প্রথমে ক্লোনাল রাইডার ভেবেছিলেন। কিন্তু পরে বুঝতে পারেন প্রজাতিটি আলাদা। তখন তারা ল্যাবে পাওয়া জেনেটিক ডাটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধারণা করেন ১ হাজার ২৪০ মাইলের কাছাকাছি এদের আসল প্রজাতি থাকতে পারে। গবেষণার জন্য পাকিস্তান, ভারত ও নেপালকে বেছে নেওয়ার পর ওয়ারিংরা থিতু হন বাংলাদেশে। বড় বড় সমুদ্রবন্দর থাকায় এই অঞ্চলকে ঘিরে তারা আসল প্রজাতি পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
গবেষকদের ধারণা, অন্ধ এবং ভূগর্ভস্থ এই পিঁপড়া বন্দর দিয়েই পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। নাবিকদের নোঙরে লেগে থাকা মাটির সঙ্গে পিঁপড়াগুলো বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশে আগে কখনো কেউ এই ধরনের পিঁপড়া শনাক্ত করেননি। তবু অনেকটা বাজি ধরার মতো এ দেশে এসে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটতে থাকেন ওয়ারিং। ক্লোনাল রাইডার অ্যান্ট নামে প্রজাতিটির কোনো রানি নেই। শ্রমিক পিঁপড়ার ভ্রুণ গর্ভনিষেক ছাড়াই বেড়ে উঠলে এরা জন্ম নেয়। দুই মিলিমিটার লম্বা এই পিঁপড়া দেখতে গাট্টাগোট্টা, চোখহীন ও হুলসমৃদ্ধ।
পিঁপড়াগুলো অন্যদের বাসস্থান খুঁড়ে খুঁড়ে বসতি গড়ে তাদের ডিম, লার্ভা খেয়ে ফেলে বলে এদের রাইডার বলা হয়। ওয়ারিং এবং ম্যাকেনজি ২০১৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে এসেছিলেন পিঁপড়ার খোঁজে। একটি জার্মান এনজিও তাদের সহায়তা করে। তৌহিদ হোসেন নামের এক শিক্ষার্থীকে তখন দোভাষী হিসেবে সঙ্গে নেন তারা। তিনজন দেশের পশ্চিমাঞ্চলে চলে যান। রাস্তা দিয়ে গাড়িতে যাওয়ার সময় কোনো জমি দেখে পছন্দ হলে সেখানে থামতেন। জমির মালিকের সঙ্গে কথা বলে, অনুমতি নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করতেন। এসব করতে করতে এক সময় বিপদেও পড়েন তারা। স্থানীয়রা মনে করেন, আমেরিকা থেকে লোক এসে খাওয়ার জন্য পিঁপড়া খোঁজ করছে!
ম্যাকেনজি সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, ‘অনেকে মনে করত কী করছে এসব। মাটি খুঁড়ে কী নিচ্ছে। নাকি পিঁপড়া খাচ্ছে।’ কিন্তু তৌহিদ সঙ্গে থাকায় ওয়ারিংদের ঝামেলা বাড়েনি। এই তরুণ স্থানীয়দের আসল ব্যাপারটি বোঝাতেন। এভাবে এক সময় আসল ঠিকানা পেয়ে যান ওয়ারিং। এক জমিতে ইট উল্টে একটি ক্লোনাল রাইডার পান। সেটি তুলে নিয়ে বড় একটি গর্ত খোঁড়েন। সেখানে পান মাত্র পাঁচটি পিঁপড়া। ওয়ারিং সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘বড় স্বস্তির সময় ছিল সেটি। কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম খালি হাতে ফেরা লাগছে না।’ দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে তারা ১৬টি আবাসস্থল পান। এর একটিতে পেয়ে যান পাঁচশর মতো পিঁপড়া। এগুলো আদ্র একটি ডিশে রেখে আবার বিপদে পড়েন। তিন ভাগ পিঁপড়াই মরে যায়। চিন্তা বেড়ে যায় ওয়ারিংয়ের। কেননা ল্যাব পর্যন্ত পিঁপড়াগুলো না আনতে পারলে জিন নকশা উন্মোচন করতে পারবেন না।
জুনে প্রকাশিত আর্টিকেলে ওয়ারিং লিখেছেন, পিঁপড়াগুলোকে নিয়ে কোনোমতে ল্যাবে ফিরে জিন নকশা উন্মোচন করতে সক্ষম হন। প্রজাতিটির উৎস আসলেই বাংলাদেশ কিনা, সেটি বোঝার চেষ্টা করেন তারা। বিশ্লেষণে সাতটি বংশ পান। এর মধ্যে দুটি ইতোমধ্যে পৃথিবীর অন্য অঞ্চলে পাওয়া গেছে। বাকি পাঁচটি কোথাও দেখা যায়নি। আরও নানাভাবে গবেষণার পর তারা নিশ্চিত হন, এগুলোর জন্ম বাংলাদেশেই। গবেষণা শেষে ওয়ারিং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘এই অনুসন্ধান মূলত আখেরি প্রাপ্তি। রহস্যের সমাধান।’
সুত্র : আমাদের সংবাদ